রহস্যের রোমাঞ্চ যখন কবিতার সিন্ধতাকে স্পর্শ করে তখন সম্ভবত থ্রিলার সাহিত্যের সব চেয়ে বেস্ট প্লট তৈরি হয়। এরকম প্লটের সর্বপ্রথম পরিচয় ঘটেছিলো সৃজিতের কাল্ট ক্ল্যাসিক বাইশে শ্রাবণ সিনেমায়। কিন্তু বইয়ের পাতায় প্রথম পড়লাম শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের “শেষ মৃত পাখি” উপন্যাসে। কিন্তু এখানে কবিতার সিন্ধতার কথা বলেলে ভুল হবে। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময়কার জ্বালাময়ী কবিতার সাথে এক উঠতি বিদ্রোহী কবি অমিতাভের হত্যা এবং প্রধান সন্দেহভাজন অমিতাভের কাছের বন্ধু অরুণ চৌধুরীর গল্পে সিন্ধতার ছোঁয়া নেই বলেলেই চলে।
তনয়া একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক। অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন পত্রিকায়। অমিতাভ মিত্রের হত্যা-রহস্য নিয়ে লেখার জন্য খুনের পঁয়তাল্লিশ বছর পর দার্জিলিঙে এলেন তনয়া। ততদিনে অরুণ চৌধুরী বিখ্যাত ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখক। লেখক এত বাস্তব ডিটেলিং করেছেন বৃষ্টিস্নাত দার্জিলিঙের। বার বার মনে পরে যাচ্ছিলো তুম্বার সিনেমার আবহাওয়ার কথা। অমিতাভ খুনের প্রধান সন্দেহভাজন হওয়া সত্ত্বেও শক্ত অ্যালিবাই থাকায় বেকসুর খালাস পেয়ে যান অরুণ চৌধুরী। “শেষ মৃত পাখি” কে শুধুমাত্র একটি রহস্যপোন্যাস বলে সত্যি অবিচার করা হবে। নকশাল বাড়ীর আন্দোলন, বাংলাদেশ-পাকিস্তান এর যুদ্ধ , সব মিলিয়ে বইটা প্রতিনিধিত্ব করছে সত্তরের দশকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুধ্ব অস্থির সময়ের। সেই সময়ের কবিতার জগতে যে বাকবদল এসেছিলো, তারও এক জ্বলজ্যান্ত ছবি এঁকেছেন শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য। এই বইতে তাই উঠে এসেছে নিত্য মালাকার, তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজয় দে, অরুনেশ ঘোষ, প্রসূন বন্দোপাধ্যায়,রণজিৎ দাশ,কৃষ্ণা বসু,পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল,অনুরাধা মহাপাত্র,শম্ভু রক্ষিত, সমীর চট্টোপাধ্যায়, সুজয় বিশ্বাস এর মত নিভৃতচারী কবিদের কথা। অরুণ চৌধুরীর কথায় আক্ষেপ ঝরে পরে সারাজীবন গোয়েন্দা কাহিনী লিখেও এসব কবিদের কবিতার সমতুল্য একটা লাইন লিখতে না পারার। “পূর্নতার ফোটা ফোটা অন্ধকার সানুদেশে ঝড়ে পরে / রাত্রি তিনপ্রহরে ডাকে মৃত্যুকাক” – তুষার চৌধুরী।
“শেষ মৃত পাখি” র প্লটের সবচেয়ে সুন্দরতম দিক ছিলো এটার নন-লিনিয়ার স্টোরি-লাইন। তনয়া যখন এই কেসের সাথে সম্পৃত্ত বেঁচে থাকা অল্প কিছু মানুষের ইন্টারভিউ করছিলেন তখন ক্রমাগত দিকভ্রান্ত হয়ে পরছিলেন। পুরো ঘটনাই অন্ধের হাতি দেখার মতন। সত্তরের দশকের দার্জিলিংয়ে হয়ে যাওয়া খুনের রহস্যকে বর্তমান সময়ে সমাধান করতে হলে প্লট স্বভাবতই নন-লিনিয়ার হয়ে যায়। তার উপরে অরুণ চৌধুরীর দেয়া ক্লু কবি অমিতাভের অসমাপ্ত রহস্যপোন্যাস তনয়াকে আরও ধোঁয়াশায় ফেলে দেয়। মিথ্যার চেয়ে ভয়ংকর বিষয় অর্ধসত্য আর সবার বয়ানের মিসম্যাচ। কাহিনীর মূল কুশীলবেরা অরুণ চৌধুরী, অমিতাভ মিত্র,ড্যানিয়েল লামা থেকে তনয়া ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থ তো বটেই, এই বইয়ের আড়ালে যে আরেকটা রহস্য কাহিনী লুকানো আছে অমিতাভের অসমাপ্ত উপন্যাস হিসেবে, তার কল্পিত চরিত্রগুলোকেও খুব যত্ন করে, বিস্তৃত করে নির্মাণ করেছেন শাক্যজিৎ। ৪০০ পৃষ্ঠার অধিক একটা বই পড়ার সময় তাই কোন একঘেয়েমি কাজ করেনি। একটা করে ক্লু ধরে অনুমান করে আগানোর পর আবার নতুন বাক আর সব শেষের ক্ল্যাইম্যক্সটা ধরা কারো পক্ষেই সম্ভব না।
সত্তরের দশকের অস্থির সময়ের ঝড়ের বাতাস লাগা অমিতাভের কণ্ঠ থেকে বের হয় বিক্ষুদ্ধ লাইন – “ নর্দমার ধারে লাশ হয়ে শুয়ে থাকলো আমার যেই বন্ধু, তার স্মৃতি যদি আমাকে তাড়িত না করে, যদি তাকে আগ্রাহ্য করে প্রেম, যৌনতা, পরকীয়া ও ডিটেকটিভ গল্পের দো-আশলা মডেলে স্বমোহন করি আর বলে বেড়াই যে রাজনীতির কথা লিখতে আমার সতীত্ত্বে নিউমোনিয়া ধরবে, তাহলে তার থেকে বড় অন্যায় এই মূহূর্তে আর কিছু নেই। ” কিংবা নির্মল হালদারের কবিতা “ অস্ত্র আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে বহুত দিন নীরব/অস্ত্রের নীরাবতায় অস্ত্রের গায়ে আমরা পেলাম মরচে/ মরচে পরা অস্ত্র নিয়ে এবার আমরা ঘাস কাটি– চলো ” রক্ত গরম করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। সত্তরের দশকের শাসনব্যাবস্থা , পুলিশের ভেতরকার ইন্টারনাল পলিটিক্স, নকশাল বিদ্রোহ দমনের জন্য হাজার হাজার তরুণের ক্রসফায়ার, প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা চাপা পরে যায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। তাই অরুণ চৌধুরীর বয়ানে উঠে আসে আক্ষেপ। সেই শোক আর আক্ষেপ ছুঁয়ে যায় পাঠককেও।
প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতে কবিতার পঙক্তি অধ্যায়টিকে ভালো মতই জাস্টিফাই করে। বইটা পরা শেষ হলে তাই মনে একটা ভালো দাগ কেটে যায়।
“মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়…
সূর্য যদি কেবলই দিনের জন্ম দিয়ে যায়,
রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের,
মানুষ কেবলই যদি সমাজের জন্ম দেয়,
সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের,
বিপ্লব নির্মম আবেশের,
তা হলে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিল?”