বাবা

বছর পাচ আগের কাহিনী। বাবা দিবসের কিছুদিন আগে। ২০২০ সালের করোনার পিক টাইমে বাবা হাসপাতালে ভর্তি। শুধু আমি আর বাবা। করোনার ভয়ে ডাক্তার, নার্স, বয় কেউ ই রোগীর কাছে ঠিক মত ঘেষতে চায় না। সারা রাত ঘুম হয় নাই। সকালে ডাক্তার ব্লাড রিপোর্ট দেখে বললেন ইমারজেন্সি ব্লাড দিতে হবে। হিমোগ্লোবিন লেভেল ৬ এর নিচে। করোনার মধ্যে ব্লাড ডোনার জোগার করা বেশ ঝামেলার। তাও এদিক সেদিক কল দিচ্ছি। কোন মতে একজন ডোনার পাওয়া গেলো। দুপুরে আসবে কথা দিলো। এইদিকে নার্স এসে বললো বাবার ভেইন পাওয়া যাচ্ছে না। হার্টে নাকি ডিরেক্ট ব্লাড পুশ করা লাগবে। সেটার জন্য যেই সেটাপ দরকার সেটা ধানমন্ডি এলাকায় পাওয়া যায় না। মিডফোর্ট হাসপাতালের আসে পাশের এলাকায় পাওয়া যায়। বাবাকে নাস্তা করায় রওনা দিলাম। দুপুরের আগেই ব্যাক করা লাগবে। ডোনার আসবে। যাওয়ার আগে ভাবলাম শাহবাগে একটা ঢু মেরে যাই। আল্লাহ এর রহমতে পেয়ে যাই। হাসপাতালে ফিরে আসতেই ডাক্তার জানালো এই সেটাপ বাবার বুকে ইন্সটল করতে হবে, সেজন্য আইসিইউ তে নিতে হবে। আমার বন্ড সাইন করা লাগবে। কাপা কাপা হাতে বন্ড সাইন করে দিলাম। বাবার কোলন ক্যান্সার ছিলো। পটি শরীরের সাথে লাগানো কোলেস্টমি ব্যাগে জমা হত। আইসিইউতে নেয়ার কিচ্ছুক্ষণ পর অনেক চিল্লাচিল্লি শুরু হয়। দুজন ডাক্তার বের হয়ে আমাকে অনেক ঝাড়তে থাকে। আইসিইউতে বাবার কোলেস্টমি ব্যাগ লিক হয়ে ময়লা ছড়িয়ে পড়েছে। নাকে মুখে কাপড় দিয়ে চিল্লাছিলো। পরে বললাম থামেন আমি সব ক্লিন করে দিচ্ছি। আইসিইউ এর ফ্লোর ক্লিন করে বাবার কোলেস্টমি ব্যাগের লিক ঠিক করে, বাবার কাপড় চেঞ্জ করতে করতে ১ ঘন্টার মত লাগলো। আইসিইউ এর সবাই দূর থেকে দেখছে। যখন বাবার লুনগি ধূতে যাচ্ছিলাম, তখন কোথা থেকে যেন একজন আয়া এসে আমার থেকে নিয়ে বললেন আমি ধূয়ে দিচ্ছি। উনাকে তখন ফেরেসতা মনে হচ্ছিলো। এই দিকে ব্লাড ডোনার এসে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে আইসিইউতে রেখে ডোনারের থেকে ব্ল্যাড নেয়ার প্রসিডিউর শেষ করলাম। তারপর বাবাকে কেবিনে দেয়া হলো। কেবিনে দিতেই বাবার কোলেস্টমি ব্যাগ ফেটে যায়। পরে একজন একপার্ট ডেকে নতুন কোলেস্টমি ব্যাগ পরালাম। শরীরে তখন আর এক ফোটা শক্তি অবশিষ্ট নাই। খেয়াল হলো আগের দিন রাতে শেষ খেয়েছি। তখন প্রায় সন্ধ্যা। বাবাকে ব্লাড দেয়া শুরু হলে ফুডপান্ডায় কি অর্ডার করবো ভাবছি। ৭ টার পর ফুড পান্ডায় ও আর কিছু পাওয়া যায় না। সব দিকেই সুনশান নীরবতা থাকে। এমন সময় ব্লাড ব্যাংক থেকে একজন স্পেশালিষ্ট রুমে এসে আমাকে ডেকে বের করলেন। জিগ্যেস করলেন ব্লাড ডোনার আমার কি হন। বললাম আমার বন্ধুর বন্ধু। উনি জানালেন ডোনার HIV পজেটিভ। মাথায় আকাশ ভাইনগা পরলো সোজা। চোখ ব্লার। এখনোই বাবাকে ব্লাড পুশ করা লাগবে। আবার ডোনার কে জানাতে হবে উনি HIV পজেটিভ। কি করবো, কোথায় যাবো। জাস্ট উপরের দিক তাকায় আল্লাহ আল্লাহ করতেছি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। উনি নতুন ডোনার ম্যানেজ করতে বললেন। বলদ হয়ে বসে আছি, বাবা জিগ্যেস করলেন কি হইসে, কিছু খাইসি কিনা। হু, হা করলাম। এদিক সেদিক ব্লাডএর জন্য ফোন দিচ্ছি। এক চাচা বুদ্ধি দিলেন কোয়ান্টামে ব্লাড পাওয়া যেতে পারে। ওদের কল করে জানলাম ব্লাড অ্যাভেইল অ্যাবল। রাত তখন ৯ টা। রাস্তায় একটা রিকশা, সিএনজি কিছুই নাই। অনেক্ষণ অপেক্ষার পর একটা সিএনজি পাই। শান্তিনগর কোয়ান্টাম এর ব্লাড ব্যাংকে যাওয়ার পর আমাকে বললো ১৪০০ টাকা জমা করতে। পকেটে হাত দিয়ে দেখি ২০০ টাকা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ফাকা। বিকাশে টাকা ছিলো, উনাকে অনেক অনুরোধ করার পরও উনি উনার পার্সোনাল বিকাশে টাকা নিতে চাচ্ছিলেন না। সেখানের ওয়েটিং রুমে ঘুরে ঘুরে যাকে পাচ্ছিলাম টাকার জন্য হাত পাততেছি। ১০০/২০০ টাকা বেশি ও সেন্ড মানি করতে চাচ্ছিলাম। পরে এক ভদ্রলোক শুধু খরচের টাকা নিয়ে সেন্ড মানি করার পর আমাকে ক্যাশ দিলেন। তারপর হাসপাতালে ব্যাক করার পর যখন বাবার ব্লাড পুশ করা হলো তখন বাবা জিগ্যেস করলেন আমি কিছু খাইসি কিনা। ঘড়িতে দেখি ১০:৩০, ফুডপান্ডা তো দূরে থাক, রাস্তার কোন চায়ের দোকান ও খোলা নাই। কিন্তু বাবারে কইলাম হ খাইছি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো বাবা। এত টা ঘটনাবহুল দিন আমার জীবনে আর আসে নাই। প্যান্ডেমিকের সময় যারা হাসপাতালের ডিউটি করছে শুধু তারা জানে কি সংগ্রাম এর মধ্য দিয়ে যেতে হইছে।

বি.দ্র. HIV পজেটিভের বিষয়টা ফলস অ্যালার্ম ছিলো। আল্লাহ এর অশেষ রহমতে ডোনার ভাইটার HIV ছিলো না।