-দত্ত-আমার-শোনা

আমার শোনা অঞ্জন দত্ত

Spread the love

তখন ইন্টারনেটের যুগ ছিলোনা। একটাই মাত্র চ্যানেল আসতো টিভিতে।  সময় কাটতো খুব ধীরে। স্কুলের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বই পড়ার তীব্র নেশা। দুবাই প্রবাসী কোন এক ভাই একটা ক্যাসেট প্লেয়ার গিফট করলো। টাকা জমায় জমায় ক্যাসেট কেনা। রেডিও শোনা। এইতো চলছিল। বলছি নব্বই দশকের কথা। একদিন কারো কাছে থেকে ধার করে আনলাম অঞ্জন দত্তের একটা ক্যাসেট। নাম শুনতে কি চাও! মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম গানগুলো। আমার জীবনে কোন রঞ্জনা ছিলোনা। কিন্তু বার বার শুনতে শুনতে কল্পানায় একজন রঞ্জনাকে ঠিকই পয়দা করে ফেলেছিলাম। ইশটিশনে বসে লজেন্স বিক্রি করা ছেলেটার দুঃখ ও ছুয়ে যেত কখনো কখনো। ক্যালসিয়াম গানটায় যেন এক প্রকার নিজেকেই খুজে পেলাম। ধন্যবাদ অঞ্জনদাকে , ছাদে গিয়ে কান্না ভুলে থাকার আইডিয়াটা দেয়ার জন্য। এখনো মাঝে মাঝে কাজে দেয়! বেলাবোসের কথা আর কি বলবো। জীবনের ফার্স্ট ক্রাশ ছিলো বেলা। যখন আলিবাবা নামের মুরগির দোকানে কাজ করা ছোট্ট সেই ছেলেটার কথা শুনতাম  কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যেত। দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়ার অনেক কিন্তু আমি দেখে ফেলেছিলাম। পুরো ‘শুনতে কি চাও’ অ্যালবামে একটা গানের আগা মাথা কিছুই বুঝিনি তখন। শুনতে কি চাও গানটার মানে। বুঝতাম না গানটার আসল মানে। বুঝেছি অনেক পরে। আসছি সে কথায়।

এর পর আস্তে আস্তে অনেকগুলো গান শোনা হয়ে গেলো অঞ্জনদার। সেই কেরানীর অফিসের লাভস্টোরি , প্রেমিকাকে বস ববি রায়ের সাথে চলে না যাওয়ার জন্য যে করুন মিনতি! কাঞ্চনজঙ্ঘা গানটায় এক থানার দারোয়ানের কি সুন্দর ভালোবাসার গল্প, যে কিনা তার পাহাড়ের ফেলে আসা বস্তিতে প্রেমিকাকে জানতে দিতে চায় না সে দারোয়ানের চাকুরী করে। জানি না কাঞ্চনজঙ্ঘায় শঙ্কর হোটেল নামে কোন হোটেল আছে কিনা। সেখানে কি সন্ধ্যায় হোটেল রুমে এখনো সেই মেয়ে চুল্লীটা জ্বালিয়ে দিতে আসে? খুব জানতে ইচ্ছে করে। চ্যাপ্টা গোলাপ গানটা এক্কেবারে জীবন থেকে যেন নেয়া। স্মার্টফোনের এই যুগে কোন কিশোরীর খাতার ভিতর কি আর গোলাপফুল কিংবা গোলাপের পাপড়ি থাকে? পনেরো তে আটকে থাকা সেই যে ছেলেটা, যে কিনা অপেক্ষায় বসে থাকে কবে তার বয়েসটা একটু বাড়বে যেন সে তার পছন্দের মানুষটাকে মনের কথা জানাবে বলে। জানি না সে আর পেরেছিলো কিনা।

আমার সব বয়েসের জন্যই অঞ্জনদার রেডিমেড গান ছিলো যেন। এক দিকে হৃদয় ভাঙার তীব্র যন্ত্রনা তার সাথে ব্যর্থ জীবনে কষ্টের আর্তনাদ। সেই সময় “আমি বৃষ্টি দেখেছি” কিংবা “শেষ বলে কিছু নেই ” গান দুটো বুক ভরা যন্ত্রনায় চোখ ভর্তি জল নিয়ে আসতো। Peter Sarstedt  এর “Where Do You Go To My Lovely” এর বাংলা অ্যাডাপশন মালা গানটা যত বার শুনেছি তত বেশি যেন ভালো লেগেছে। দেবলীনায় উঠে এসেছে চিরচরিত মধ্যবিত্ত প্রেমিকের সাথে উচ্চবিত্ত প্রেমিকার ব্যাবধান। “সময় আমার কড়া নেড়ে গেছে মাথার ভেতর, হৃদয়ের দরজায় / আটোসাটো হয়ে থাকব কি করে, চারিপাশে বড়ই অবক্ষয় / উপড়ে গেছে শেকড় আমার, বনেদিয়ানার আমি ছিন্নমূল / দেবলিনা, দেখেছিলে যেটা আমায় নিয়ে স্বপ্নতো নয়, চোখের ভুল।” লাইন গুলো যেন লাখো উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের প্রেম কাহিনীর একটা কষ্টমাখা প্রেজেন্টেশন।  ইগো কে আকড়ে ধরে থাকা দুটো মানুষকে নিয়ে “দুটো মানুষ” গানটা একবারে বাস্তব জীবন থেকে যেন নেয়া। “দু জনেই বসে থাকে হাত ধরবে বলে কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলে না” সবশেষে  এভাবে কেউ চলে যায় ? মুষলধারে এক বৃষ্টিতে দেখা হয়ে যাওয়া দুই প্রাক্তন প্রেমিক প্রেমিকার গল্প “একদিন বৃষ্টিতে” গানটা যেন সত্যি সত্যি চোখের সামনে দেখা যায় দুজন কে। পরিবারের চাপে কালো মেয়ে ম্যারি অ্যান কে ফেলে সাদা চামড়ার কোন মেয়ে কে বিয়ে করা ছেলটার দুঃখ যেন হৃদয় ছুয়ে যায়। খুব সাধারন লিরিক্সে সাধারন কোন কিছুকে অসাধারন ভাবে ফুটিয়ে তোলার কাজ টা কি অঞ্জনদার চেয়ে ভালো কেউ পারে? চিঠি কে গানে রুপান্তরিত করা যেন একটা শিল্পের লেভেলে নিয়ে গিয়েছেন অঞ্জন। রমা যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তার লিখা চিঠিটা যেন একটা ক্লাসিক পিস। হ্যাপি বার্থডে গানটা শোনার পর থেকে খুব জানতে ইচ্ছে করে ভবঘুরে লোকটি কি পেরেছিলো ন্যাপকিন টা পোস্ট করতে?

মধ্যবিত্ত জীবনের কষ্ট, কান্না, আশা , ভালোবাসা এই সব জিনিসগুলো বার বার ফিরে এসেছে অঞ্জনের গানে। পাচতারা হোটেলের স্যাক্সোফোন বাদক স্যামসনের দুঃখ গুলো কেউ জানবেনা। বুকের ভেতর জমানো অসাধারন সুরগুলো বাদ দিয়ে তাকে সবসময় সস্তা হিন্দি গানগুলোই বাজিয়ে যেতে হয়। রাতে ফিরে এসে সেই সস্তা মদের গন্ধভরা চাদর বিছানায় ঘুমানো। রাজা রায়ের মতন কতশত যুবক একটা নায়কের রোলের আশায় সিনেমা পাড়ায় ঘুরে ঘুরে  যৌবন শেষ করে তার কোন ইয়াত্ত্বা নেই। জ্যামিতিতে ৭৯ আর ইংলিশে ৮৩ পাওয়া সেই ডাক্তার লেনের ষোড়শী মেয়ে জঈতা যে কিনা দারিদ্র্যের তীব্র কষাঘাতে পড়াশোনা ছেড়ে  কাজে নেমে পড়ে। অঞ্জনের সাথে আমিও যেন জঈতার প্রেমে পরে যাই। রঙ পেন্সিল গানটা শুনলে যেন বুকের ভেতরটা  হা হা করে উঠে। খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ফেলে আশা কৈশোরে।

আমাদের বাংলাদেশেও কিন্তু অঞ্জনের কিছু কাজ আছে। নিমা রহমানের সাথে ৫০ মিনিটের একটা শ্রুতিনাটক “প্রিয় বন্ধু”। অসংখ্য বার শোনা এই নাটক টা। দুই চিঠি বন্ধুর একে অপরের প্রেমে পড়া কিন্তু দুই জনের মধ্যে বিস্তর ব্যাবধান। হ্যাপি আখন্দ কে নিয়েও একটা গান লিখেছিলেন অঞ্জন। একটা কেকের দোকান নিয়েও যে গান গাওয়া সম্ভব এটা গামা সাহেবের কেক গানটা না শুনলে বুঝতাম না। অঞ্জনদার এক একটা গান এক একটা সিনেমা। বড় ক্যানভাসের স্টোরি। শেষ করবো সেই শুনতে কি চাও গান দিয়ে। আস্তে আস্তে বড় হয়ে ওঠা , হারিয়ে ফেলা কৈশোর , টিফিনের টাকা দিয়ে খেলনা বাঁশি কেনা থেকে শুরু করে বড় হয়ে ওঠা। তারপর টিফিনের পয়সা দিয়ে কেন হয় সিগারেট। বিয়ে করা , বড় হয়ে যাওয়া , ৯ – ৫ টা অফিস সব কিছুর ভীড়ে যেন সেই হারানো ছেলেবেলা ফিরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কার না থাকে ?

শুনতে কি চাও তুমি সেই অদ্ভুত বে-সুরো সুর
ফিরে পেতে চাও কি সেই আনচান করা দুপুর
দেখতে কি চাও তুমি সেই খেলনাওয়ালাটা কে
তার খেলনা দোতারা সে বাজাচ্ছে কবে থেকে।

স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা
সেই অদ্ভুত ফাটা বাঁশ আর মাটির সুর টানা টানা
দু’দিনের সম্পদ দু’টাকার বাজনার বিষ্ময়
তারপর কখন হঠাৎ সুখের মানে পাল্টে যায়।

তারপর টিফিনের পয়সা দিয়ে সিগারেট
কলেজ কেটে সিনেমা বান্ধবীর সাথে কাটলেট
আসে দশটা পাঁচটা সেই একরুটের বাসটা তারপর
সবার মতই পড়তে হয় যে কাগজের টোপর।

এখন মাসের শেষে মাঝে মধ্যে কান্না পায়
মিনিবাসে দাড়িয়ে অফিস যাবার সময়
এখন বুঝেছি সেই অদ্ভুত সুরের কি মানে
ফিরে তো যাওয়া যায় না যে আর সেখানে।

যেতে হবে যে তোমাকে আমাকে চলে
লুকোনো টেক্কা সংসারের এক্কা দোক্কা ফেলে
প্রথমে যাবে ঘর-দোর দোকানপাট তারপর হৃদয়
কিছুই হলো না বাজানো গেল না সময়।

ইদানিং সে সুরটা শুনতে যে খুব ইচ্ছে হয়
কিন্তু সেই খেলনাওয়ালা আর আসেনা পাড়ায়
হয়তো কোন অন্য অলি-গলি ঘুরে
অন্য কোন কাউকে টানছে সেই অদ্ভুত সুরে।


Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *